নিজস্ব প্রতিবেদক, সেন্টমার্টিন থেকে :: ইটের দালানকোঠার ভারে দিন দিন সেন্টমার্টিন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দ্বীপ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সেখানকার বাসিন্দারা। দ্বীপে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা আবাসিক হোটেল ভেঙে ফেলতে দুই বছর আগে নির্দেশ দেন আদালত। তা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, বরং দিন দিন দ্বীপে বাড়ছে দালানকোঠার সংখ্যা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দ্বীপের জেটিঘাট থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে পশ্চিমপাড়া। সেখানে সাবেক ইউপি সদস্য রশিদ আহমদের ছেলে মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিনের নতুন বাড়ি নির্মাণ করতে দেখা যায়। বেশ কয়েজন শ্রমিক প্রবালের টুকরাগুলো দিয়ে বানাচ্ছেন সীমানা প্রাচীর। পাঁচটি কক্ষের মধ্যে দু’টি কক্ষের দেয়াল তোলা হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এভাবে দ্বীপের পশ্চিম, মাঝার ও কোনাপাড়ায় আরও বেশ কয়েকটি দালান তুলতে দেখা গেছে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষের পাকা ভবনও রয়েছে। এছাড়া দ্বীপে অবাধে আহরণ হচ্ছে শামুক-ঝিনুক-পাথর।
সৈকত সংলগ্ন এলাকায় হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও দোকান নির্মাণের জন্য কেয়াবন ও ঝোপঝাড় কেটে ফেলা হচ্ছে। হোটেলের জেনারেটরের আওয়াজে দ্বীপে শব্দ দূষণ হচ্ছে। পর্যটন মৌসুমে মানুষের অতিরিক্ত চাপে পানি ও পরিবেশ দূষণে হুমকিতে পড়ে দ্বীপের প্রায় ৬৮ প্রজাতির প্রবাল।
বাড়ি নির্মাণের বিষয়ে বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘দ্বীপ কর্তৃপক্ষের কাছ অনুমতি নিয়ে দালান নির্মাণ করছি। দ্বীপে শুধু আমি একা এ কাজ করছি না। এখানে আরও অনেকে দালান নির্মাণ করছেন। তাছাড়া এখানে বিশাল ভবন নির্মাণ হয়েছে। এতে দ্বীপের কিছু সমস্যা হয়নি। সামান্য এই দালান নির্মাণ করলে দ্বীপের বড় ক্ষতি হবে না।’
দ্বীপের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানায়, দ্বীপের উত্তর অংশের এক বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে গড়ে উঠেছে ৮৪টিরও বেশি হোটেল-মোটেল ও ৩০টি রেস্টুরেন্ট। গত পাঁচ বছরে ৫৬টির মতো বহুতল হোটেল তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘দালানের ভারে দিন দিন দেবে যাচ্ছে সেন্টমার্টিন। ফলে সামান্য জোয়ার পানি বাড়লে দ্বীপের চার দিকে ভেঙে যাচ্ছে। গত দুই বছরে দ্বীপের দক্ষিণপাড়া, হরা বনিয়া, গলাচিপা, জাদির বিল, কোনাপাড়া, উত্তর বিল, পশ্চিমপাড়া, ডেইলপাড়াসহ ১৫টি জায়গায় দেড় শতাধিক ঘর ভেঙে গেছে।’
কেউ দ্বীপ নিয়ে চিন্তা করছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শুধু পর্যটন অর্থনীতি সুফল আদায়ের লোভে একের পর এক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দ্বীপ একদিন হারিয়ে যাবে।’
স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, সেন্টমার্টিনে স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলেই রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কিছু কর্মকর্তার একটি চক্রকে ম্যানেজ করতে হয়। তাদের যোগসাজশে টেকনাফ থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটারের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইট, লোহা, সিমেন্ট, বালুসহ যাবতীয় নির্মাণ সামগ্রী পৌঁছে যায় সেন্টমার্টিনে।
সংশ্লিষ্ট দফতর ম্যানেজ থাকায় এসব নির্মাণসামগ্রী নির্বিঘ্নে নির্মাণ স্থলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোনও বাধা ছাড়াই গড়ে উঠছে হোটেল, কটেজ ও রেস্তোরাঁ। আবার অনেক সময় দ্বীপের তিন দিকে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক পাথর ব্যবহৃত হচ্ছে অবকাঠামো তৈরিতে। সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোটের আপিল বিভাগ। নির্দেশ অনুযায়ী, সেন্টমার্টিনে ছোট কিংবা বড় কোনও স্থাপনাই নির্মাণের সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও সেখানে গড়ে উঠছে একের পর এক স্থাপনা।
সেন্টমার্টিন হোটেল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা পর তারা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এখন বিষয়টি আদালতের মাধ্যমের নিষ্পত্তি হবে। নিষেধাজ্ঞার পর থেকে তারা নতুন কোনও অবকাঠামো নির্মাণ করেননি। আগে যেসব হোটেল ছিল, সেগুলোতে কার্যক্রম চলছে।
পাঠকের মতামত: